Ad

Tuesday, February 26, 2013

২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শোক দিবস পালনের আহ্বান স্বজনদের










‘চার বছর ধরে আশায় আছি, কখন এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে, কিন্তু বিচার তো পাই না। নিহত দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা তো কোনো অন্যায় করেননি। ওদের সন্তানরা কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারে না, তাদের স্ত্রীরা তাদের দুঃখ কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারে না। কেন তাদের এভাবে জীবন দিতে হলো, কী অপরাধ ছিল তাদের!’ পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল লুত্ফুর রহমানের বোন তাসলিমা রহমান এভাবেই দুঃখ প্রকাশ করে বিলাপ করছিলেন বনানী গোরস্তানে। শুধু তিনিই নন ক্ষোভে ফুঁসছেন নিহত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বজনেরা।
গতকাল ছিল পিলখানা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বার্ষিকী। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআরের জওয়ান নামধারী কিছু বর্বর ঘাতকের তপ্ত বুলেটে সেদিন নিহত হয়েছিলেন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৩ জন। সোমবার সকালে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বনানী সেনা কবরস্থানে ছুটে যান তারা।
লুত্ফর রহমানের বোন তাসলািম সাংবাদিকদের বলেন, দেশে এত বড় একটি ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, এর পেছনে যারা ছিল, তাদের বিচার যেন সুষ্ঠু সুন্দরভাবে হয়। দেশের মানুষ যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে পায়। পাশাপাশি এই দিবসটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করারও দাবি জানান শোকার্ত এই বোন।
নিহত আরেক সেনা কর্মকর্তার বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখন আল্লাহর দরবারে বিচার চাই। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত বিচার চাইছি। মহান আল্লাহ এদের যথাশাস্তি দেবেন। কিন্তু সরকারের কাছে দাবি জানাই, এ দিনটিকে যেন জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়, সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তাহলেই নিহত সবার আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।’ নিহত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল এমদাদের বোন বলেন, ‘এখন অনেককেই জাতীয় বীর আখ্যা দেয়া হয়। তাহলে পিলখানায় যারা প্রাণ দিলেন তাদের কে কী বলা হবে?’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ছোট কোনো ক্ষতি হলেই রাজনীতিবিদরা সেদিকে ছুটতে থাকেন। আর এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড হয়ে গেলেও এ দিনটিকে আজও শোক দিবস হিসেবে গণ্য করা হলো না। এটি কি খুব বড় চাওয়া? শুধু স্বজনদেরই নয়, এ হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রেরও কি কম ক্ষতি হলো? একজন সেনা কর্মকর্তা তৈরি করতে রাষ্ট্রের কম অর্থ ব্যয় হয়েছে!’
নিহত মেজর হুমায়ুন হায়দারের বোন শারমিনা পারভিন সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তিনটা দিন আমরা অন্ধকারে ছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো একটু পরেই ভাইয়া ফিরে আসবেন। ভাবিকে তিনি ফোন করে বলেছিলেন, সাথী, বেঁচে থাকলে কথা হবে, মরে গেলে ক্ষমা করে দিও। সবশেষ সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় শেষ যোগাযোগ হয় আমাদের সঙ্গে। দরবার হলের বাথরুমে ঢুকে ভাইয়া মোবাইল ফোনে একটি এসএমএস পাঠিয়েছিল। সেটাই শেষ যোগাযোগ।’ বিচার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিডিআর আইনে এ অপরাধের শাস্তি সামান্য। কিন্তু যে ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে দোষীরা—সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত ছিল।’
এই সেনা কর্মকর্তার এক ছেলে তাসিন বাবার এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক সইতে না পেরে সাড়ে তিন মাসের মাথায় মারা যায় বলেও জানান শারমিনা।
নিহত মেজর শাহনেওয়াজের মা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘বাবারা, সন্তান হারানোর বেদনা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় না। যার কোল খালি হয় সেই জানে তার কষ্ট।’ তিনি বলেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটি খুবই ভয়াবহ দিন। এদিন অনেক মায়ের সন্তান শহীদ হয়েছিলেন। আমাদের অনেক চাওয়া ছিল এর বিচার নিয়ে। এখন তো সবই নিয়তি মনে হয়। হয়তো বা আমাদের চাওয়া পূরণ হবে না, তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে আরজি জানিয়ে যাই।’
মেজর শাহনেওয়াজের ভাই হোসাইন শামীম ইফতেখার বলেন, ‘যে গতিতে বিচার এগোচ্ছে মনে হচ্ছে, অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। তবে তাতেও যদি প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পায় নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে। আর এদেশ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসবে। প্রত্যেক নিহতের স্বজনরা সেটাই চায়।’
এদিন সকাল থেকেই সেনা কবরস্থানে তৈরি হয় শোকাবহ পরিবেশ। ফুল হাতে, সজল চোখে নিহতদের স্বজনরা যখন উপস্থিত হন তখন কারও মুখেই কোনো কথা ছিল না। তবে অকালপ্রয়াত প্রিয় মানুষটির কবরের পাশে গিয়ে কেউই কান্না ধরে রাখতে পারেননি। তাদের কান্নাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল প্রিয়জন হারানো কী গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। এ সময় তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেন।
এদিকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের চতুর্থ বার্ষিকী উপলক্ষে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে গতকাল রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে ‘ফিরে দেখা ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ শীর্ষক’ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া বিএনপির পক্ষে বনানী গোরস্তানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন লে. জে. মাহবুবুর রহমান।
পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবসে গতকাল পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান, ইউনিট ও বিওপি পর্যায়ে গতকাল বাদ ফজর পবিত্র কোরআন খতম, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ১০টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
আজ মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টায় পিলখানার বীর-উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদ ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়, পিলখানায় কর্মরত সব অফিসার, জেসিও, অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করবেন বলে কথা রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বাংলাদেশ ন্যাপ নিজ কার্যালয়ে পিলখানা ট্র্যাজেডি উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে দলের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, পিলখানা ট্র্যাজেডি দেশের জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ন্যাপ নগর সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুননবী ডাবলুর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন এনডিপি মহাসচিব আলমগীর মজুমদার, ন্যাপ যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ শাহজাহান সাজু, কল্যাণ পার্টি যুগ্ম মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান, কেন্দ্রীয় সদস্য নজরুল ইসলাম মণ্ডল, এনডিপি নগর সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদউদ্দিন, ন্যাপ সম্পাদক শাহ মো. শাহ আলম, নগর সহ-সভাপতি ডা. হাকিম মো. রিয়াজউদ্দিন, সম্পাদক জিল্লুর রহমান পলাশ, মো. কাউছার আলী, বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রদল সভাপতি এম এন শাওন সাদেকী, সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান সোহেল প্রমুখ।

No comments:

Post a Comment

Ad