Ad

Monday, February 25, 2013

হত্যাকাণ্ডের রাতে তানজিলা ছিল রাজীবের বাসায়

নিহত স্থপতি ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনের স্ত্রী আনিকা জানান, ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট তাদের বিয়ে হয়। আগে প্রেম ছিল। খুব সহজ-সরল ও মেধাবী ছিল রাজীব। সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রচার করতো। এক সময় নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। তদন্ত কর্তৃপক্ষ মনে করছে, রাজীব হত্যার পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে বিষয়টিকে তেমন জোরালো মনে করছে না তদন্ত কর্তৃপক্ষ।

সম্পর্কটা কখন এমন হলো জানতে চাইলে আনিকা বলেন, বিয়ের পর থেকেই আমাকে সারাদিন একা থাকতে হতো। খুব মনযোগ দিয়ে চাকরি করতো না ও। এক চাকরিও বেশি দিন করতো না। তাকে সিরিয়াসলি চাকরি করতে বলি। বলি আমার বাবা-মার বাসা ছেড়ে চলো আলাদা বাসায় ওঠি। পরে একটা চাকরিতে জয়েন করে সে। ভাবলাম নিজেও কিছু করি। তখন ও আমাকে বলে, তোমার সঙ্গে ছায়ানটের সম্পর্ক ভালো, তো ওখানে কিছু একটা করো। পরে ছায়ানটে জয়েন করি, ২০১১ সালের নভেম্বরে।

অনিকা জানান, রাজীবকে বিয়ের পর থেকে দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ও খুবই সোচ্চার। অনলাইনে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে লেখালেখি করতো। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য অনেক অনুরোধও করেছি। বলেছি ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে, এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। কিন্তু আমার কোন কথাই শুনেনি সে। নিজের মতো করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত এ কারণে তাকে জীবনও দিতে হলো। বললেন কথাগুলো। সোমবার কথা হয় তার সঙ্গে।

অনিক বলেন, সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম, একই সময় রাজীবও ফিরতো। দুজনই ক্লান্ত থাকতাম। রাজীব বলতো এ কারণে দু জনের মধ্যে আগের মতো গল্প করা হয় না। আবেগেরও ঘাটতি হচ্ছে। ও বলতো আমি তাকে সময় দেই না, গল্প করি না। এ নিয়ে প্রায় তর্ক-বিতর্ক হতো। এভাবে দিনের পর দিন ঝগড়ার কারণে সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে যায়। এমনিতে সহজ, সরল ও ভদ্র হলেও হঠাত্ রেগে যেতো। তখন তার রাগ ভাঙাতে অনেক কষ্টে হতো।

আনিকা বলেন, পরে রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন হায়দার পরামর্শ দেন কিছুদিন আলাদা থাকলে হয়তো সম্পর্কটা আগের মতো হয়ে যাবে। গত বছরের মে থেকে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজীব আলাদা থাকা শুরু করে। পল্লবীর পলাশনগরে তাদের বাসায় গিয়ে ওঠে। ওখানেও ল্যাপটপে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালাতো দিনভর। কতদিন নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিয়েছি ওকে। ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে থাকতো সে। খাবারের কথা ভুলে যেতো।


খুনের কারণ তানজিলা : পল্লবী থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের মামলা সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানায়, ব্লগার রাজীব খুনের কারণ তানজিলাসহ একাধিক প্রেমিকা। ঘটনার রাতে রাজীবের বাসায়ই তানজিলা ছিল বলে নিশ্চিত করেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, খুনের সময় তানজিলা রাজীবের বাসায় ছিল। সেদিন তানজিলার ওই বাসাতেই থাকার কথা ছিল। পল্লবী থানা পুলিশ রাজীবের খালাতো ভাই এবং আপন ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে রাজীবের বাসা থেকেই তানজিলাকে গ্রেফতার করে বলেও জানায় পুলিশ।
তানজিলাকে জিজ্ঞাসাবাদে তার কথায় গরমিল পাওয়া গেছে। এমনকি তানজিলার দেয়া মিরপুর পলাশনগরের ১৩ নম্বর রোডের কবরস্থানের পাশে বোনের বাসার ঠিকানার অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি বলে জানায় পুলিশ। তবে তানজিলাসহ আরও অনেক মেয়ে ওই বাসায় রাতযাপন করতো বলেও জানায় পুলিশ। পুলিশের তদন্তে রাজীবের একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া, লিভ-টুগেদারের বিষয়গুলো চলে আসে। অন্যদিকে তানিজলার বাসার ঠিকানার জন্য পল্লবী থানায় গেলে ডিউটি অফিসার আবুল হোসেন জানান, তানজিলা ও রাফিকে গ্রেফতারের মাত্র ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই ডিবি পুলিশ নিয়ে যায়। তাই সাধারণ ডায়রি বা থানার কোনো নথিপত্রে তাদের গ্রেফতারের কাগজপত্র নেই। রাজীব হত্যা মামলার আইও মতিয়ার রহমান ফোনে জানান, ডিবি পুলিশ নিয়েছে, তারাই ভালো বলতে পারবে। মতিয়ার রহমান ব্যস্ত আছি বলে আর কথা বলতে চাননি।
 
রাজীবের বাসা ও এলাকায় ঘুরে যে চিত্র পাওয়া গেল : পলাশনগর ১১ নম্বর রোডের ৫৬/৩ নম্বর বাড়িটি রাজীবের মা নার্গিস হায়দারের নামে। একতলা এ ভবনের সামনে ও পেছনে বেশ কিছু খালি জায়গা রয়েছে। সেখানে কয়েকটি বড় গাছপালাও রয়েছে। চারপাশে দেয়ালে ঘেরা বাড়িটির ভেতরটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। ভেতরে দু’কক্ষবিশিষ্ট বাড়িটিতে ঢুকে দেখা যায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সামনের এক চিলতে বারান্দায় সব জুতো পুরুষের। সার্বক্ষণিক নারীদের থাকার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তালাবদ্ধ রুমে রাজিব থাকত বলে জানায় দায়িত্বরত পুলিশ। তবে বারান্দা ও কক্ষে প্রচুর মদের বোতল দেখা গেছে। এলাকাবাসী ও চায়ের দোকানদাররা জানান, গত তিন চার বছরে অনেক মেয়েকে এ বাড়িতে আসতে দেখেছেন তারা। নাম প্রকাশ করতে চাননি এমন কয়েকজন বলেন, বউ আসবে কি করে, এখানে তো নার্গিস আক্তার কখনও থাকেন না। তবে রাজীবের বউ এখানে কখনও আসেননি সে ব্যাপারটিও নিশ্চিত করেন তারা। সামনের ছোট গলিতে ভাড়া বাসায় থাকা এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, বাড়ির গেটে তালাবদ্ধ রেখে তারা বাড়ির ভেতরেই থাকত। এক চা দোকানি বলেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে রাজীব সিগারেট খেত না। সিগারেট নিয়ে সোজা বাসায় চলে যেত’।
 
চার বান্ধবীকে ঘিরে এগোচ্ছে রাজীব হত্যার তদন্ত : ব্লগার আহমেদ হায়দার রাজীব শুভ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এগোচ্ছে চার ব্লগার বান্ধবীকে ঘিরে। এদের মধ্যে একজন তানজিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে রাজীবের বাসা থেকেই। অপর বান্ধবী রাফিও রয়েছে গোয়েন্দা হেফাজতে। গোয়েন্দা সংস্থা মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তিনটি নম্বর পেয়েছে, যেগুলো রাজীবের কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। ওই নম্বরগুলো হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। পুলিশ এখন ওই নম্বরের মালিকদের খুঁজছে। তাদের ধারণা, সেসব নম্বরের কোনোটি ঘাতকদেরও হতে পারে। রাফি ও তানজিলার বিষয়ে কিছু তথ্য জানালেও অপর দু’ব্লগার বান্ধবীর বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে সম্মত হয়নি পুলিশ। তাদের বক্তব্য, তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না।
তদন্ত সূত্র জানায়, ব্লগার বান্ধবীদের মধ্যে তানজিলার প্রতিই গোয়েন্দাদের সন্দেহ বেশি। অপর বান্ধবী রাফির প্রতিও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না রাজীবের স্ত্রী আনিকা ওরফে বাসন্তিও। একটি সূত্র বলেছে, খুনি যে-ই হোক, তারা যে এক নারীর সহায়তা নিয়েছে, সে সম্পর্কে এখন অনেকটাই নিশ্চিত। এক্ষেত্রে তাদের সন্দেহ তানজিলার দিকে। তাদের ধারণা, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সব ঘটনা সম্পর্কে অবগত এই তানজিলা। তবে পুলিশ আহমেদ হায়দার রাজীব শুভ হত্যাকারীদের সম্পর্কে গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে কর্মকর্তারা বলেছেন।
একাধিক সূত্র বলেছে, তানজিলা এবং রাফির সঙ্গে এতই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যে, দিনে তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা ও দেখা হতো। তাদের মোবাইল কললিস্ট ও মোবাইল ট্র্যাক করেও সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তদন্ত সংস্থার দেয়া তথ্যমতে, মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে ১৩, ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাজীবের অবস্থান সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। রাজীবের অবস্থান এবং কাদের সঙ্গে ওই দিনগুলো অবস্থান করেছে, সেসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশত মোবাইল নম্বরের ভয়েস রেকর্ড সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রাজীব শাহবাগে অবস্থান করেছিল। ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ছিল ধানমন্ডিতে। সন্ধ্যা ৬টায় সে ফের শাহবাগে যায় এবং রাত ৮টা পর্যন্ত অবস্থান করে। রাতে পল্লবীর বাসায় ফিরে যায়। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি সে শাহবাগে যায়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাজীব খুন হয়। ১৩ তারিখ রাতে ফেরার পর ঘটনার দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত সে পলাশনগরের বাসায় ছিল। ওই সময়টা সে কাটিয়েছে বান্ধবী তানজিলার সঙ্গে। ৩টায় বাসা থেকে বের হয়ে বাসার অদূরে বাইশটাকি এলাকায় গিয়ে ৪টায় আবার সে বাসায় ফিরে আসে। সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত সে বাসার আশপাশে পলাশনগর এলাকাতেই ঘোরাফেরা করে। বাসা থেকে বের হয়ে আবারও বাইশটাকি এলাকায় যায়। সেখানে ১৫ মিনিট অবস্থান করে সাড়ে পাঁচটায় আবারও বাসায় ফিরে আসে। এর কিছু সময় পরে আবারও বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর ও আশপাশের এলাকায় কিছু সময় অবস্থান করে। এরপর রাত সাড়ে আটটার পর বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় তার সেই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তানজিলা তাকে বাসার গলিতে পৌঁছে দেয়। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে তানজিলার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয় রাজীবের ।
রাত ৮টা ৫৮ মিনিটে রাজীব আরেক বান্ধবী রাফির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাসার সামনে রাস্তায় চলে আসে। রাত ৮টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত সে বান্ধবী রাফির সঙ্গে কথা বলে। সেটাই ছিল ফোনে রাজীবের শেষ কথা বলা। গোয়েন্দারা ধারণা করছে, এরপরই সে হামলার শিকার হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাত ৮টা ৪৪ মিনিট থেকে রাজীবের বাসার সামনে তিনটি নতুন মোবাইল নম্বর যুক্ত হয় টাওয়ারের সেল নম্বরে। সেই নম্বরগুলো বেশ কিছু সময় একই স্থানে অবস্থান করে। রাত ৯টা ১৪ মিনিটের পর থেকে ওই তিনটি মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে। গোয়েন্দারা ওই মোবাইল ফোনগুলোর গ্রাহকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, ওইসব নম্বরের কোনোটি ঘাতকদেরও হাতে পারে। রাত ১০টায় রাজীবের মোবাইলে একটি এসএমএস পাঠায় তানজিলা। এসএমএসটি ছিল ‘দাদা বাসায় গেছ?’ ওইসময় তানজিলার অবস্থান ছিল মিরপুর-২ নম্বর এলাকায়। অথচ তার স্বীকারোক্তিতে সে বলেছে, মিরপুর ১১ নম্বরের বাসায় রাজীব তাকে পৌঁছে দিয়েছে।
তানজিলা সম্পর্কে জানা গেছে, এসএসসি পাস করে বখে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির মেয়ে ছিল তানজিলা। রাজীবের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল সে ধরনের। তানজিলার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সাতমাথা এলাকায়। বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া এগোয়নি তানজিলার। চার বছর আগে ঢাকায় এসে মিরপুর ১৩নং এলাকার একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তার পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ।
জানা গেছে, নিজের থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে অনৈতিক পথে পা বাড়ায় তানজিলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট শাহবাগ এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে চলাফেরা শুরু করে। এর মধ্যে ফেসবুকে রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তাদের এ ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেনি শোভনের স্ত্রী বাসন্তি ওরফে অনিক। এতে স্ত্রীর সঙ্গে রাজীবের দূরত্ব বাড়ে। স্বামীর সঙ্গে অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি মেনে নেয়নি ধনির দুলালী অনিকা। কয়েক মাস আগেও রাজীব শ্বশুরের বাসা ধানমন্ডিতে থাকত। চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে রাজীবকে সে বাসা থেকে একরকম বের করে দিয়েছিল।
একটি সূত্র জানায়, রাফি ময়মনসিংহ ত্রিশালের কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। তার বাবা সরকারি চাকরিজীবী। ময়মনসিংহ থাকা অবস্থায় ফেসবুকে রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হয় রাফির। সেই সূত্র ধরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নিয়মিত ঢাকায় এসে রাজীবের সঙ্গে দেখা করত রাফি। রাজীবও ময়মনসিংহ গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করত।
রাজীব ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ছিল তানজিলার। রাফিও ঢাকায় আসা-যাওয়ার কারণে নিত্যনতুন বন্ধুর সন্ধান পায়। এর মধ্যে শোভনের সঙ্গে তানজিলার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে রাফির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় শোভনের। শুক্রবার রাতে তানজিলা থেকে আলাদা হয়ে রাফির মান ভাঙানোর চেষ্টা করে রাজীব। রাফি কোনো সুযোগ না দিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর পরপরই দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয় রাজীব। এ খুনের সঙ্গে একজন নারীর সহযোগিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে সেই নারী তানজিলা না রাফি, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, খুনি যে-ই হোক, তারা তানজিলা অথবা রাফির সহায়তা নিয়ে খুন করেছে। হয় খুনিরা রাফির অভিমানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজীবের বাসার ঠিকানা ও বাসায় ফেরার সময়সূচি জেনেছে, না হয় তানজিলার অভাবটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে খুনের কাজে তার সহায়তা নিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঘটনার দিন রাজীবকে বাসা থেকে ডেকে নেয় তানজিলা। নানা ছলনায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে বাসায় ফিরতে বাধ্য করেন। সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর রাজীবের পরিবারের সদস্যরা তার অবস্থান সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছে, তার সঙ্গে প্রযুক্তি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের অনেক গরমিল রয়েছে। তিনি দিন-রাত শাহবাগ চত্বরে থাকতেন বলে যে দাবি করা হয়েছে, তার সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত সংস্থা।

ব্লগার রাজীব হত্যাকান্ড : দুই তরুণীর মধ্যে কোনো একজন খুনিদের সহায়তাকারী

অন্যদিকে যাযাদি লিখেছে, স্থপতি ও বস্নগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন খুনের ঘটনায় পুলিশের তদন্তে ‘সহায়তাকারী’ তরুণী তানজিলা ও রাফিকে ঘিরে রহস্য বাড়ছে। তারা শোভনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলে পুলিশ দাবি করছে। গত তিন দিন ধরে তাদের ডিবি কার্যালয়ে পুলিশ হেফাজতে রাখা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের আটক বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তাদের দাবি, তারা খুনিদের শনাক্ত করতে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করছে। তারা কোন ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে এ দুই তরুণীর মধ্যে কোনো একজন খুনিদের সহায়তাকারী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি পুলিশ। এদিকে ঘটনার ৪ দিন পার হলেও খুনিদের গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শোভনের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। গত শুক্রবার রাতে পল্লবী থানাধীন পলাশনগর এলাকায় দুর্বৃত্তদের চাপাতির কোপে নিহত হন স্থপতি ও বস্নগার আহমেদ রাজিব হায়দার শোভন। এ ঘটনায় ওইদিন ভোরে তার বাবা নাজিমউদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে পল্লবী থানায় মামলা করেন। এরপর রোববার মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ঘটনার চারদিন পার হয়ে গেলেও এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র এসি তৌহিদুল ইসলাম জানান, শোভনের বান্ধবী তানজিলা ও রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা মূলত শোভনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক কার্যকলাপের তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করছে। তাদের দেয়া তথ্যমতে ইতোমধ্যে পুলিশ কিছু দূর পর্যন্ত তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগিরই খুনিরা গ্রেপ্তার হবে।
 
তদন্ত সূত্র জানায়, রাফি ময়মনসিংহ ত্রিশালের কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। তার বাবা সরকারি চাকরিজীবী। ময়মনসিংহ থাকা অবস্থায় ফেসবুকে শোভনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেই সূত্র ধরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নিয়মিত ঢাকায় এসে শোভনের সঙ্গে দেখা করতেন রাফি। শোভনও ময়মনসিংহ গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেন। অপর বান্ধবী তানজিলার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সাতমাথা এলাকায়। বাবা মারা যাওয়ার পর এইচএসসি পাস করে আর লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। ৪ বছর আগে ঢাকায় এসে মিরপুর ১৩ নাম্বার এলাকার একটি রুম নিয়ে তিনি বসবাস শুরু করেন। তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাদের ধারণা, এ হত্যাকান্ডে একজন নারীর সহায়তা রয়েছে। খুনি যেই হোকে তারা তানজিলা অথবা রাফির সহায়তা নিয়ে খুন করেছে। হয় খুনিরা রাফির অভিমানকে হাতিয়ার হিসেবে শোভনের বাসার ঠিকানা ও বাসায় ফেরার সময়সূচি জেনেছে। না হয় তানজিলার অভাবটাকে হাতিয়ার হিসেবে খুনিরা ব্যবহার করেছে। তবে এই মুহূর্তে খুনিদের সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্যই কৌশল হিসেবে তানজিলা ও রাফির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা গেলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। পুলিশের এ কৌশল অনেকটা ‘হোস্টেস নেগোসিয়েশনের’ মতো।
মূলত পুলিশ সহায়তাকারী নারীকে আগে শনাক্ত করতে চাচ্ছে। খুনিদের সঙ্গে তাদের মধ্যে কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে এই মামলায় যেকোনো সময় গ্রেপ্তার দেখানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন বিকালে তানজিলাই শোভনকে বাসা থেকে ডেকে নেন এবং নানা কৌশলে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত করে বাসায় ফিরতে বাধ্য করেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের ব্যাপারে কিছু ক্লু পাওয়া গেছে। তার দেয়া তথ্যমতে কয়েকজনের কললিস্ট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে খুনিদের সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে। ওই কর্মকর্তা জানান, খুনিরা অনেক ধুরন্ধর। তারা পুলিশের প্রযুক্তি কৌশল সম্পর্কে অবহিত। এই কারণে খুনিদের অবস্থান বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে গোয়েন্দাদের। খুনিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নাম্বারের ঠিকানাও ভুয়া।

No comments:

Post a Comment

Ad